হাফিজ আলম সাইরানী: এক সৎ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে স্মরণে
- Pasharul Alam

- Oct 13
- 4 min read
বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু মানুষ আছেন যাঁদের জীবন ও কর্ম এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। তাঁদের মধ্যে হাফিজ আলম সাইরানী ছিলেন একজন — যিনি রাজনীতি করেছেন মানুষের জন্য, ত্যাগ ও সততার সঙ্গে। তাঁর মৃত্যুতে রাজনীতি হারিয়েছে এক নিবেদিতপ্রাণ কর্মীকে, আর আমি হারিয়েছি একজন সহযোদ্ধা, বন্ধু ও প্রিয় মানুষকে।
১৯৮৮: মালদা বি.এড কলেজে প্রথম সাক্ষাৎ
১৯৮৮ সালে এম.এ. পাশ করে আমি ট্রেনিং নিতে গেলাম মালদা সরকারি বি.এড কলেজে। তখন আমরা ছিলাম কয়েকজন ফ্রেশার এবং কয়েকজন কর্মরত শিক্ষক, যারা ট্রেনিং নিতে এসেছিলাম। প্রথম দিন ক্লাসে নিজের বাড়ির ঠিকানা জানালাম। সম্ভবত সেই সময় ক্লাসে যিনি শিক্ষক ছিলেন তাঁর নাম ছিল কার্তিক বাবু। ক্লাস শেষে দুইজন শিক্ষক এসে বললেন— “আমাদের বাড়িও চাকুলিয়ায়।” তিনজনে মিলে গেলাম পাশের এক চায়ের দোকানে। এভাবেই শুরু হল এক নতুন বন্ধনের সূচনা।
দুই দিন পর আবার কলেজে গেলাম। কোথায় থাকব, এই নিয়ে কথা হচ্ছিল। তখন শিক্ষক হাফিজ আলম সাইরানী ও আইয়ুব আলি আমাকে হোস্টেলে থাকার প্রস্তাব দিলেন। তাঁরাই আমাকে কলেজ অফিসে নিয়ে গিয়ে হোস্টেলের ফর্ম পূরণ করে দিলেন। খুব অল্প সময়েই তাঁদের আন্তরিকতায় হোস্টেল পেয়ে গেলাম। ওরা থাকত প্রথম তলায়, আর ওদের থেকে দুটি ঘর পরে আমার থাকার ব্যবস্থা হল।
বন্ধুত্বের বন্ধনে
কবে যে এই দুই শিক্ষক, বিশেষ করে হাফিজ সাহেব আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেলেন, তা স্পষ্ট মনে নেই। সন্ধ্যায় হোস্টেলে বসে আমরা একসঙ্গে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতাম। মনে আছে, সেদিন ছিল শচীন টেন্ডুলকারের প্রথম ব্যাটিং। ওর খেলায় মুগ্ধ হয়ে আমি টিভির পর্দায় চুমু খেয়েছিলাম। হাফিজ সাহেব চুপচাপ এক বিশেষ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। চারপাশের হাততালিতে সেদিন হোস্টেল মুখরিত হয়ে উঠেছিল।
প্রতিদিন আমরা রেললাইন পার হয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার হাঁটতে হাঁটতে কলেজে আসতাম। একদিন তাৎক্ষণিক বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম হই। আমার বক্তব্য শুনে হাফিজ সাহেব যেন আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়লেন। সেই বন্ধুত্ব এরপর আর কোনোদিন বিচ্ছিন্ন হয়নি।
রাজনৈতিক ও আদর্শিক সাযুজ্য
পারিবারিকভাবে হাফিজ সাহেব ফরোয়ার্ড ব্লকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, আর আমি ছিলাম কমিউনিস্ট পরিবার থেকে আসা। ফলে আদর্শিক দূরত্ব ছিল না বললেই চলে। একই এলাকার মানুষ, একই রাজনৈতিক বিশ্বাস— এসব আমাদের আলোচনায় প্রজন্মের ফারাককে বিলীন করে দিয়েছিল।
বি.এড শেষ করার পরও আমাদের সম্পর্ক অটুট ছিল। আমি তখন সূর্যাপুর অর্গানাইজেশন-এর একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী, আর তিনি পরবর্তীতে রাজ্যের মন্ত্রী। যোগাযোগের মাধ্যম আজকের মতো সহজ ছিল না, কিন্তু প্রয়োজন হলে ফোনে বা সরাসরি আলোচনা করতাম।
আন্দোলনের সময় পাশে থাকা এক মানুষ
টাসো আন্দোলনের সময় বাম সরকার সে আন্দোলনকে ভালো চোখে দেখত না। তবুও ব্যক্তিগত সম্পর্কে কোনো ছেদ পড়েনি। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের আন্দোলনের সময় আমাদের সংগঠন NAPM-এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। মেধা পাটকরের নেতৃত্বে আমরা শত শত মানুষ নিয়ে জমির অধিকারের দাবিতে পথে নামতাম। কিন্তু কখনোই হাফিজ সাহেব আমার এই আন্দোলনে অংশ নেওয়াকে নিরুৎসাহিত করেননি। একজন রাজ্যের মন্ত্রী হয়েও তিনি বুঝতেন মানুষের লড়াই কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
২০১১ সালের একটি স্মরণীয় দিন
২০১১ সালের জানুয়ারির একদিন আমি কলকাতায় সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ দিয়ে কলেজ স্ট্রিটের দিকে যাচ্ছিলাম। ফরোয়ার্ড ব্লক অফিসের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ তাঁকে ফোন করলাম। বললেন, “অফিসে আছি, চলে এসো।” সেদিন দীর্ঘ আলোচনা হল নানা বিষয়ে।
এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন— “আজকাল রাইটার্স বিল্ডিং যেতে ইচ্ছে করে না। আমলারা আর আমাদের কথা শুনে না। তোমরা সবাই মিলে সরকারটা বদল করে দিবে, কিন্তু যাদের হাতে ক্ষমতা দিচ্ছ, একদিন আফসোস করবে। ক্ষমতা যদি তোমাদের হাতে রাখতে পারতাম, তাহলে দুঃখ ছিল না।”
সেই কথাগুলো আজও মনে গেঁথে আছে। এটি ছিল তাঁর হৃদয়ের গভীর থেকে বলা কথা।
সততার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
হাফিজ আলম সাইরানী রাজ্যের একজন মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু তাঁর নামে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ কোনোদিন ওঠেনি। বরং এমনও হয়েছে, তাঁকে মন্ত্রী হয়েও সত্যেও তার জীবনযাপন ছিল সহজ-সরল। এমন সৎ ও নিষ্কলুষ রাজনীতিক আজ বিরল। এই কারণেই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম।
হাফিজ আলম সাইরানী: এক রাজনৈতিক নক্ষত্রের প্রস্থান
।। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন ।।
বাংলার রাজনীতির এক নিবেদিতপ্রাণ কর্মী, বামপন্থী রাজনীতির অভিজ্ঞ নেতা এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সহ-সভাপতি হাফিজ আলম সাইরানী ২০২৪ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে তিনি আর স্বশরীরে আমাদের মাঝে আর নেই। ১৯৬০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করা এই মানুষটি তাঁর পুরো জীবন উৎসর্গ করেছেন মানুষের কল্যাণে।
প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা
উত্তর দিনাজপুরের বিনারদহ গ্রামে এক সূর্যাপুরী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন হাফিজ আলম সাইরানী। তাঁর বাবা ছিলেন অঞ্চলের একজন জমিদার। বড় ভাই রমজান আলী ছিলেন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও প্রাক্তন বিধায়ক। ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় সাইরানীর মধ্যে ছোটবেলা থেকেই জন্ম নেয় রাজনৈতিক চেতনা। চাকুলিয়া হাইস্কুলে পড়াশোনা শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্যে ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবনের সূচনা করেন এবং মালদা বি.এড কলেজ থেকে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন।
রাজনৈতিক জীবন
১৯৯৪ সালে প্রথমবার গোয়ালপোখর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন। মানুষের সঙ্গে তাঁর গভীর সংযোগ ও আন্তরিকতা তাঁকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ত্রাণ ও সমবায় দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। তিনি ফরোয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সেক্রেটারি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
২০২২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ফরোয়ার্ড ব্লক থেকে পদত্যাগ করে ৩ নভেম্বর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন যা ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়।
মানুষ হাফিজ আলম সাইরানী
তিনি ছিলেন সহজ-সরল, সৎ, নিষ্ঠাবান ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন নেতা। ছাত্র থেকে কর্মী সবাই তাঁকে ভালোবাসতেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তান রেখে গেছেন।
এক বন্ধুর চোখে এক নেতার স্মৃতি
হাফিজ সাহেবের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব শুধু রাজনৈতিক নয়— ছিল গভীর মানবিক সম্পর্ক। আমাদের অসংখ্য হাঁটা পথ, হোস্টেল জীবনের রাত, আলোচনা, বিতর্ক আর পারস্পরিক শ্রদ্ধা আজ আমার স্মৃতির অমূল্য সম্পদ।
তাঁর মতো সৎ ও নিঃস্বার্থ রাজনীতিক আজ বিরল। বাংলার রাজনৈতিক পরিসর তাঁকে চিরকাল স্মরণ করবে একজন আদর্শবান জননেতা হিসেবে।