top of page

রাস্তায় কান, মাটিতে পা

  • Writer: Sandipan Chakraborty
    Sandipan Chakraborty
  • Nov 7
  • 3 min read

বাম জমানায় রাজ্যে মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু হাফিজ়ের ভিতরে থাকা সেই ছেলেটা হারিয়ে যায়নি। স্বভাবে মাটির মানুষ। যেখানেই যান, যান-চালক থেকে চায়ের দোকানের লোক— মাটির কাছাকাছি থাকা সকলের সঙ্গে গল্প জমাতেন।

ree

অফিসে এসে পার্টি অফিসে চলে এসো। তার পরে আমরা যাব একটা জায়গায়। বলে রেখেছিলেন আগের দিন। সম্পর্ক মানে শুধু তো খবরের নয়। অসমবয়সি বন্ধুত্ব। তাঁর ডাকে যেতে হতে। সে দিন একটা গাড়ি চেপে আমরা চলছিলাম বিধাননগরের দিকে। রাস্তায় নানা গল্প। কিন্তু গন্তব্য কোথায়, সেটা নিয়ে কিছুই বলেননি তিনি। রহস্য রেখেছিলেন। শেষমেশ গাড়ি গিয়ে থেমেছিল যে বাড়ির সামনে, সেটা কমল গুহের মেয়ের বাড়ির ঠিকানা! দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিলেন উদয়ন গুহ! কোচবিহারের নেতা উদয়নকে নিয়ে তখন প্রবল সঙ্কট চলছে ফরওয়ার্ড ব্লকে। দলের রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষ তাঁর বিশ্বস্ত দুই রাজ্য নেতা হাফিজ় আলম সৈরানি এবং নরেন চট্টোপাধ্যায়কে দায়িত্ব দিয়েছিলেন রফাসূত্র বার করার। নরেনের মাথা একটু গরম, উত্তেজিত হয়ে এমন সব কথা বলে ফেলেন যে, জট আরও পাকিয়ে যায়! সৈরানি তুলনায় শীতল। তাই তাঁর সঙ্গে সে দিন একান্ত আলোচনা ছিল উদয়নের। তাঁকে জানিয়েই সৈরানি সঙ্গে রেখেছিলেন সাংবাদিক-বন্ধুকে। তখনকার মতো ক্ষোভ প্রশমিত হয়েছিল উদয়নের। খুব খুশি হয়েছিলেন অশোক। তবে বেশি দিন আর উদয়ন ওই দলে থাকেননি। বাবার দলের পাট চুকিয়ে চলে গিয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসে।


একটা ছোট্ট ঘটনা কত কিছু বোঝাতে পারে, জানি না। তবে এই রকমই ছিলেন সৈরানি। বিশ্বাস মানে বিশ্বাস। বন্ধুত্ব মানে বন্ধুত্ব! সম্পর্ক তৈরি হওয়ার পরে এমন হেন ঘটনা নেই যা সৈরানির গোচরে ছিল কিন্তু আলোচনা করেননি! ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য দফতর হেমন্ত বসু ভবনে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসবেন অশোকের সঙ্গে কথা বলতে, মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারির বিপণি খোলা নিয়ে বিরোধের জেরে ফ ব-র মন্ত্রীরা পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে বামফ্রন্ট সরকারে চাপ বাড়াবেন, আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএমের সঙ্গে অঘোষিত দ্বিপাক্ষিক বৈঠক— অজস্র এমন ঘটনা আছে। কোনটা এবং কতটা লেখা যাবে, তার পরিমাপও পারস্পরিক জরিপে ঠিক করা থেকেছে চির কাল। 


হেমন্ত বসু ভবনের নীচের তলায় দলীয় মুখপত্র ও প্রকাশনার স্টল। সেখানেই বিকালের দিকে পাওয়া যেত সৈরানিকে। চিনি ছাড়া চা, সিগারেটের প্যাকেট সঙ্গী। সূর্যালোকের নীচে যে কোনও বিষয়ে অনর্গল আড্ডা। উত্তর দিনাজপুরের চাকুলিয়ার ভূমিপুত্র, সুর্জাপুরী উচ্চারণের প্রভাব তাঁর কথায়। জলকে বলতেন ‘জোল’। মাঝেমধ্যে ইন্টারকমে উপর থেকে ‘অশোকদা’র ডাক এলে দৌড়তে হত উপরে। স্কুলের চাকরি ছাড়িয়ে সর্বক্ষণের রাজনীতিতে এনে অশোকই সৈরানিকে বড় দায়িত্বের জন্য তৈরি করেছিলেন। তাঁকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকতে বলে ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছিলেন। বাস্তবে সেটা আর হয়নি। অশোকের মৃত্যুর পরে দলের ভিতরকার অবস্থা, নেতাদের ভাবভঙ্গি কেমন ভাবে পাল্টে গেল, সে সব নিয়ে আক্ষেপ ছিল সৈরানির।

গোয়ালপোখরের জনপ্রিয় নেতা রমজ়ান আলির হত্যাকাণ্ডের পরে পরিবারে বিপর্যয় এসেছিল। সেই সময় মোকাবিলা করেই এগিয়েছেন। রমজ়ানের ছেলে আলি ইমরান রাম্জ় (ভিক্টর) তখন ছোট। ভিক্টরের মা জেলে। ভাইপোকে মানুষ করেছেন, পাশাপাশি আবার নিজের ছেলে-মেয়েকেও। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু গল্প করেছিলেন, ‘‘হাফিজ়কে আমি প্রথম দেখেছিলাম রমজ়ানের ওখানে গিয়েই। ওরা একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট করতে, অনেক লোক আসতে। সেই উপলক্ষেই একটা খাওয়া-দাওয়ার আসরে নিয়ে গিয়েছিল। হাফপ্যান্ট পরে একটা ছেলে সে দিন ভাতের উপরে মাংস পরিবেশন করছিল। সেটাই হাফিজ়!’’ সেই ছেলেই পরে বাম জমানায় রাজ্যে মন্ত্রী ছিলেন। জ্যোতি বসু এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, দুই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই কাজ করেছেন। ফরওয়ার্ড ব্লকে অশোকের মতো নেতার অধীনে রাজনীতি করেছেন। কিন্তু হাফিজ়ের ভিতরে থাকা সেই ছেলেটা হারিয়ে যায়নি। স্বভাবে মাটির মানুষ। সকলের কথা মন দিয়ে শুনতেন। নির্বাচনী প্রচার, সাংগঠনিক কাজ বা ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনার জন্য কোথাও দিতে যাওয়া, যেখানেই যান, যান-চালক থেকে চায়ের দোকানের লোক— মাটির কাছাকাছি থাকা সকলের সঙ্গে গল্প জমাতেন। ‘বাস্তব’ বোঝার চেষ্টা করতেন। এবং বলতে অকুণ্ঠ ছিলেন, ‘‘শুধু আমরা বললে হবে না, কলমের জোর আছে ভাই! পারলে একটু লিখো।’’


যে দলের জন্য চাকরি ছেড়ে পূর্ণ সময়ের রাজনৈতিক কর্মী হয়ে যাওয়া, সেই দলে পরে ঠোকাঠুকি ক্রমশ বড় বিবাদের চেহারা নিল। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে বিতণ্ডা বাধতে থাকল। প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছে গেল মতবিরোধ। দলের যুব সংগঠনের কিছু নেতা-কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে সৈরানি চেষ্টা করেছিলেন আন্দোলন-কর্মসূচির পথে থাকার। সেই জায়গাও ক্রমে সঙ্কুচিত হয়ে এল। ভাইপো ভিক্টরের পাশাপাশি তিনিও পা বাড়ালেন কংগ্রেসে। অধীর চৌধুরী তখন প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি। সেখানে চলে গেলে ফ ব-র দফতরে সেই আড্ডার তা হলে কী হবে? সৈরানি বলেছিলেন, ‘‘অফিসটা বদলে যাবে রে ভাই। ওই অফিসে হবে তখন!’’ বিধান ভবনে বারকয়েক আড্ডা হয়েছে। খুব বেশি নয়।


কিছু রাজনীতিক থাকেন, যাঁরা সংগঠনে উচ্চ পদে গেলেও হোমরা-চোমরা হন না। প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেন না। সৈরানি এই গোত্রে পড়তেন। যাঁদের জোগান এখন কমে আসছে। কংগ্রেসে গিয়ে তাদের দল ও রকম-সকমের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কিছু আড়ষ্টতা ছিল। তবে মাটিতে পা এবং কান রেখে চলার অভ্যাসে বদল হয়নি। কোথায় কী হচ্ছে, খবর নেওয়া এবং প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে খবর পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আদানপ্রদান চালু ছিল।

আগে বলেছি, কিছু একটা ঘটছে কিন্তু সৈরানি সেটা নিয়ে কথা বলছেন না, এটা হত না। হল আসলে এক বারই। আর জি কর-কাণ্ড নিয়ে তুলকালাম চলার সময়ে সৈরানি আচমকা কোথায় হারিয়ে গেলেন। এই সে দিন ভিক্টরের ফোন না-পেলে জানাই হত না, ভদ্রলোক ক্যান্সারে হঠাৎ কাবু এবং মৃত্যুশয্যায়। কয়েক দিন পরেই অন্তিম সংবাদ।


এই নীরবতা, এই গোপনীয়তার চুক্তি সৈরানির সঙ্গে ছিল না।

 
 
  • Facebook
  • YouTube

© Hafiz Alam Sairani Memorial Forum

bottom of page